মহাবিশ্ব কত বড়

মহাবিশ্ব কত বড়? ও এর সৃষ্টি রহস্য কি?: চতুর্থ পর্ব

অ) এতক্ষণ যে বিষয়টি সামনে রেখে এত কথা বললাম, তাহলো মহাবিশে^র সৃষ্টির রহস্যকে ঘিরে। উল্লেখ্য যে, আমাদের আদরের পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। আর জেমস ওয়েবের সুবাদে ১৩০০ কোটি বছর আগের মহাজগৎ সৃষ্টির শুরুর বিষয়ে অনেকটা অবগত হয়েছি। তবে অনেকে ঘুরে বসে বলতে পারেন যে, এটি কিভাবে সম্ভব? সেই কথাই এখন বলবো- এ প্রেক্ষাপটটে উল্লেখ্য যে, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের শক্তিশালী ক্যামেরাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট হলো যে, এগুলো ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করতে পারে এবং একই সঙ্গে সেই আলোতে ছবিও তুলতে পারে।

এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করার দরকার কি? এই প্রশ্নের জবাবে পদার্থ বিজ্ঞানের আওতায় আলোর বিষয়টির উপর বিশ্লেষণমুখী নজর দিতে হবে। কেননা আমরা জানি যে, আলোর গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে সেকেন্ড ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল (৩ লাখ কিলোমিটার)। এদিকে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব মতে আলোর শক্তি, তার কম্পাষ্কের সমানুপাতিক। মজার ব্যাপার হলো যে, আলো যখন কোনো উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে একই মাধ্যম চলতে থাকে, তখন তার গতিবেগের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। অথচ আলোকতরঙ্গ হলো মূলত বিদ্যুৎ চুম্বক তরঙ্গ, যার কম্পাষ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য একে অপরের বিপরীত আনুপাতিক। সহজ কথা হলো যে, তরঙ্গ যদি বেড়ে যায়, কম্পাষ্ক কমে যায়। এক্ষেত্রে হাবল থেকে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছি যে, মহাবিশ^ ক্রমগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর মহাবিশ^ প্রসারিত হচ্ছে বিধায় একই সঙ্গে আলোর তরঙ্গও প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেরে যাচ্ছে। এদিকে আলোর বর্ণালির সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল। আর আলোর সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে বেগুণি। এটি সত্য যে, লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেলে তা হয়ে উঠে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তির সীমানার বাইরে। এখানে সোজা কথা হলো যে, অবলোহিত আলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা জানি যে, আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়ে লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় লাল সরণ (জবফ ংযরভঃ)। আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গিয়ে বেগুণি বা নীল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় নীল সরণ (ইষঁব ংযরভঃ)।

আর এই লাল সরণের পরিমাণ হিসাব করে জানা যায় যে, মহাবিশ^ কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে এবং সেই সময়ে আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে। তখন সেই দূরতে¦র হিসাব থেকে সময়ের হিসাব সহজে বের করা যায়। এদিকে আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করে। আর তাই সেই হিসাবে আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে, সেই দূরত্বকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ (খরমযঃ ণবধৎ)। এই সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, কোনো একটি নক্ষত্র যদি পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে এক বছর। আর এর সপক্ষে আরেকটি উদহারণ হলো, সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। এখানে আমরা উল্টোভাবে বলতে পারি যে, পৃথিবী থেকে যখন আমরা সূর্যকে দেখি, তখন আসলে দেখি ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড অতীতের সূর্য। সেহেতু এ সময়কে আলোর গতি দিয়ে গুণ করলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, আকাশে যেসব সূর্য ও তারকারাজি দেখি, সেগুলো থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌছাতে যদি কোটি আলোকবর্ষ লাগে, তাহলে সেগুলো কোটি বছর আগের নক্ষত্র দেখেছি বললে ভুল হবে না। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি যে, এই জেমস ওয়েব টেলিষ্কোপের ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা অবলোহিত আলো শনাক্ত করতে পারে। যদি কিছুটা ঘুরিয়ে বলি তাহলে এই দাঁড়ায় যে, কোটি বছরের সফর শেষে এই আলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নায় এসে প্রতিফলিত হয়। আর ইনফ্রারেড ওয়েব ডিটেক্টর সেই আলো শনাক্ত করে এবং একই সঙ্গে সেখান থেকে তৈরি করে গভীর মহাকাশের ছবি। এক্ষেত্রে আরও কথা হলো যে, ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ থেকে মহাবিশে^ ভাসমান সব ধরনের অণুর ধর্ম বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে যে, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণী আছে কি না? যাহোক, এতক্ষণ যে বর্ণনা করলাম, তাতে কী প্রতীয়মান হয় যে, মহাবিশে^র সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা কত কাছাকাছি চলে এসেছি।

আ) উপর্যুক্ত আলোচনায় এতক্ষণ মহাবিশে^র সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কর্তৃক প্রেরিত আদি গোড়ার ছবি নিয়ে কিছু কথা বলেছি। আর ভবিষ্যতে জেমস ওয়েব যে ছবি পৌনঃপুনিকভাবে পাঠাবে, তাতে হয়তো আরও পরিস্কার হবে। এই তো কয়েক বছর আগে পদার্থ সৃষ্টিধর্মী ঈশ^র কণা (এড়ফ চধৎঃরপষব) নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো সেটা সম্পর্কে তেমন কোন কথা আর কানে আসে না। আমি সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী হলেও এখন যে কিছু কথা বলবো, সম্মানিত পাঠকবর্গ আপনার অন্যভাবে নেবেন না। আমি তখন ঈশ^র কণার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম যে ধর্মগ্রন্থ বিশেষ করে ইসলামী পবিত্রগ্রন্থ কুরআন ও হাদিস বিশ্লেষণ করে দেখুন, পদার্থ সৃষ্টির পেছনে দু’টি নিয়ামক কাজ করে, তার একটি আলো (খরমযঃ) এবং অন্যটি হলো শব্দ (ঝড়ঁহফ)। এই বিষয়টি যদি ঘুরিয়ে বলি, তাহলে প্রতীয়মান হয় যে, পদার্থ সৃষ্টিকল্পে আলো ও শব্দের পরোক্ষ ক্রিয়াশীল প্রপঞ্চের (চযবহড়সবহধ) ভূমিকা, যা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এখানে আলো বলতে আল্লাহ তা’লার নূর এবং শব্দ হলো তাঁরই হুকুম। এদিকে ¯্রষ্টার সৃষ্টি এই বিশ^ ব্রহ্মা- এতটাই অত্যাশ্চার্য, যা মানুষের মস্তিস্কের নিউরনে বুঝার মতো সেই প্রোগ্রাম নেই। তবে জীবকুলের শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও সুদূরপ্রসারী কৌশল (ঝঃৎধঃবমু) খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

যদিও মানুষ তার সম্পূর্ণ মস্তিস্কের সামান্য অংশই ব্যবহার করতে পারে। আর ইতিপূর্বে জেমস ওয়েবের যে অভাবনীয় বিষয়াদি উল্লেখ করেছি, তা মনুষ্যজীবের মস্তিস্কের মাধ্যমে ¯্রষ্টার খেয়ালের ফসল বই কিছু নয়। হয়তো আপনারা সদয় অবহিত আছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞান মহাকাশ সম্পর্কে অধিকতর সচেষ্ট হয়েছে। অথচ পবিত্র কোরআনে প্রায় ১৫০০ বছর আগেই একাধিক আয়াতে এ ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে। এদিকে বিজ্ঞানের ভাষ্য মতে বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্লাকহোল হয়ে বর্তমান সৃষ্টি এ পর্যায়ে এসেছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, সেই আদিতে নাকি সময় (ঞরসব) পর্যন্ত ছিল না। পরে নাকি ৪র্থ মাত্রা (৪ঃয উরসবহংরড়হ) হিসেবে দৈর্ঘ্য, প্রস্ত ও উচ্চতা মাত্রার সঙ্গে বস্তু (গধঃঃবৎ) ও ঘূর্ণন (গড়ঃরড়হ) এর মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। কথাটি তো ঠিক। কেননা ধর্ম মতে যখন কিছুই ছিল না, তখন তো সময় থাকার কথা নয়।

আর বিজ্ঞান মতে মহাকাশে যে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ, উপগ্রহ ও তারকা সম্বলিত গ্যালাক্সির কথা বলা হয়েছে। সে ব্যাপারে কুরআনে প্রকারান্তরে উল্লেখ আছে। এখানেই শেষ নয়, নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, মহাশূণ্য গভীর ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ভূ-পৃষ্ঠ নির্মাণ কাজ সমাধার পর তিনি (আল্লাহ তা’লা) আকাশ নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করলেন। আর তখন তা ছিল ধোঁয়াশাঘেরা (সূরা ফুসিসলাত, আয়াত-১১)। ইদানিং বিজ্ঞানে সময় ভ্রমণ (ঞরসব ঞৎধাবষ) এর কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে নবী করীম (সঃ) কর্তৃক সংঘটিত “মেরাজ” এর বিষয়টি টেনে এনে যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এর যোগসূত্র খুঁজে পেতে হয়তো বেগ পেতে হবে না।
আসলে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে নানা কথা বলে থাকি। সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণেই মাঝেমধ্যে আমাদের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়। পরিশেষে এই বলে শেষ করছি যে, মহাবিশে^র সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করা অতটা সহজ নয়। তবে জেমস ওয়েবের কর্মকান্ডকে স্বাগত জানাই। হয়তো এর সুবাদে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা হলেও জট খুলবে। আর আমরা সেই সোনালী দিনের জন্য অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

সূত্র ঃ
১। বিজ্ঞানচিন্তা, আগস্ট, ২০২২ বছর ৬, ইস্যু- ১১।
২। বিশিষ্ট দার্শনিক মোঃ মফিজুল হক।
৩। দৈনিক কালেরকণ্ঠ ১৫/০৭/২০২২ (মহাকাশ নিয়ে কোরআনের বিস্ময়কর তথ্য- মুফতি সাআদ আহমদ)।
৪। উইকিপিডিয়া।
৫। কিশোর আলো, আগস্ট- ২০২২, বছর-৯, ইস্যু-১১ (মহাবিশে^র প্রথম আলো সন্ধানে-উচ্ছ্বাস তৌসিক)।
৬। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন- ১৯/১/২০২২, ০১/০৪/২০২২, ০২/০৪/২০২২, ১৩/০৭/২০২, ১৪/০৭/২০২২ এবং ২৫/০৮/০২২।
৭। বিজ্ঞান মনস্ক সংশ্লিষ্ট সুধীজনের সঙ্গে আলোচনা।
৮। লেখকের দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতা।
৯। ইত্যাদি।

বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
ঊসধরষ: ধনফঁষনধশর৮৫@ুধযড়ড়.পড়স/িি.িমড়ড়হরলড়হ.পড়স , ০১৮১৩৩৩৩৩৩৫ * ০১৬৭০৪৫১৪৭৫ * ০২-৪৮১১৯০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *