ইসলাম মহান আল্লাহর দেয়া একমাত্র দ্বীন তথা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বর্তমান সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে চলতে গেলে আমাদেরকে নানাবিধ বাধাবিপত্তি ও প্রতিকুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এতে করে মানুষ হিসেবে আমাদের মনের মধ্যে নানাবিধ অস্থিরতা ও দু:চিন্তার উদ্রেক হয়। অনেক মানুষ এই হতাশা ও দু:চিন্তা থেকে মুক্তির আশায় মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যাদির ছোবলে পড়ে যায়। তখন তারা নানাবিধ পাপাচার ও অসামাজকি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে; নেশার রাজ্যে বুদ হয়ে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে। এতে সাময়িকভাবে অস্থিরতা থেকে কিছুটা মুক্তি পেলেও এর পরে আগের চেয়েও অস্থিরতা ও মানসিক অশান্তি বৃদ্ধি পায়। অথচ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার মধ্যে যে মানসিক তৃপ্তি ও প্রশান্তি নিহিত রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। অদ্যকার নিবন্ধে আমরা মানসিক প্রশান্তি অর্জনে ইসলামের সুমহান কতিপয় দিক নির্দেশনা তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।
১.তাকদীরের ভালো ও মন্দের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে হবে:
একজন মানুষ যখন তাকদীর তথা ভাগ্য লিখনের উপর পূর্ণ আস্থা রাখেন, তখন কোন দু:চিন্তা তাকে কাবু করতে পারে না। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর ঘোষণা:
“আল্লাহ যদি তোমাকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন করতে চাহেন, তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই, আর আল্লাহ যদি তোমার কোন কল্যাণ করতে চাহেন, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে চাহেন অনুগ্রহ দিয়ে ধন্য করেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল বড়ই দয়ালু”। (সূরা ইউনুস-১০৭)
২. আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল/ভরসা রাখতে হবে:
আল্লাহ তা’য়ালার উপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে। তিনি যে সকল বালা মুসিবত দূর করতে পারেন; এ ব্যাপারে পর্ণ আস্থা রাখতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” (সূরা তালাক-৩)
৩. আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষন করতে হবে:
আল্লাহ সম্পর্কে একজন বান্দার এমন ধারণা পোষন করতে হবে যে, তিনি তার দুরাবস্থা থেকে নাজাত দিতে সক্ষম। হাদীসে এসেছে: মহানবী সা. বলেছেন,“আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেন, আমি সেরুপ, যেরুপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।” (বুখারীÑ৬৯০১)
৪. আল্লাহ তা’য়ালাকে গভীরভাবে ভালোবাসতে হবে:
কোন মানুষ যখন আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালাকে গভীরভাবে ভালোবেসে নিজের জীবনকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করতে পারবে, তখন সকল প্রকার বালা মসীবতে সবর করা তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। শত কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারবে। ফলে তার মন থেকে অস্থিরতা ও হাহাকার দূরীভূত হয়ে যাবে। মন প্রশান্তিতে ভরে উঠবে।
৫.দুনিয়ার বিপদের তুলনায় আখেরাতের বিপদের কথা বেশী স্মরণ করতে হবে:
আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন যেমন সামান্য; তেমনি দুনিয়ার বিপদও আখেরাতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির তুলনায় নগন্য। মহান আল্লাহ বলেন, “যেদিন তারা আখেরাত প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধা অথবা এক সকাল অবস্থান করেছে।” (সূরা নাজিয়াত-৪৬)
৬. ধৈর্য ধারণ করতে হবে:
সকল পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কষ্টের পরে সুখ আছে, কঠিন অবস্থার পরে সচ্ছলতা আসে। এ ব্যাপারে আল্লাহ পাকের ঘোষণা রয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা আল বাকারা-১৫৩)
ধৈর্যধারনের পাশাপাশি উক্ত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।
৭. সত্য কথন ও লিখনে অভ্যস্ত হতে হবে:
সত্যবাদিতার মধ্যেই রয়েছে মানসিক প্রশান্তি। পক্ষান্তরে মিথ্যায় রয়েছে মানসিক অশান্তি, সন্দেহ, সংশয় ও অস্থিরতা। নবীজি সা. বলেছেন:“সত্য হলো প্রশান্তি, আর মিথ্যা হলো সংশয়। ” (মুসনাদে অহমদ) কথায়, কাজে, লিখনে এবং আচরনে সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
৮. আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করতে হবে:
ফরজ সালাত আদায়ে যত্নবান হতে হবে এবং সম্ভাব্য নফল আদায়ে মনোনিবেশ করতে হবে। ফরজ রোযা আদায়ের পর সাধ্যমত নফল রোযা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দান, সাদাকাহ ইত্যাদি জনহিতকর কাজে মনোনিবেশ করলে ডিপ্রেশন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজতর হবে। কুরআন তেলাওয়াত করা ও শুনার অভ্যাসও দু:চিন্তা থেকে মুক্তির অনন্য একটি উপায়।
৯.বেশী বেশী ইস্তেগফার করতে হবে:
আল্লাহর নিকট নত হয়ে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “অতপর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ও সন্তান-সন্ততিতে”। (সূরা নূহ-১০-১২)
নবীজি সা. বলেছেন,যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দিবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দিবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দিবেন। (আবু দাউদ-১৫২০)
১০. নবীজি সা.এর উপর দরুদ পড়তে হবে:
নবীজি সা. এর উপর দরুদ পড়লে মানসিক প্রশান্তি অর্জিত হবে। হাদীসে এসেছে, হযরত উবাই বিন কা’ব রাঃ নবীজি সা.কে বলেন, আমি আপনার উপর অধিক হারে দরুদ পড়ে থাকি। আমার সময়ের কতটকু আপনার প্রতি দরুদ পাঠে ব্যয় করবো? রাসূল সা. বলেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। আমি বললাম, এক চতর্থাংশ সময়? তিনি বলেন, তোমার ইচ্ছা। কিন্তু যদি আরো বাড়াও তবে ভালো। আমি বললাম, অর্ধেক সময়? তিনি বলেন, তোমার যা ইচ্ছা, তবে আরো বাড়ালে তা ও ভালো। আমি বললাম, দুই-তৃতীয়াংশ সময়? তিনি বলেন, তোমার ইচ্ছা, তবে আরো বাড়ালে তা ও ভালো। আমি বললাম, আমার সবটুকু সময় আপনার উপর দরুদ পাঠে লাগাবো? তিনি বলেন, তাহলে তো তোমার চিন্তামুক্তির জন্য তা যথেষ্ট হয়ে যাবে আর তোমার গুনাহ মা’ফ করা হবে। (তিরমিজি-২৪৫৭)
১১. চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিতে হবে:
নিজের চেয়ে নিচের মানুষদের দিকে তাকাতে হবে। ভাবতে হবে, আল্লাহ আপনাকে তার থেকে ভালো রেখেছেন। মনোবিজ্ঞানীরাও ডিপ্রেশনের চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে এভাবে চিন্তা করার উপদেশ দিয়ে থাকেন।
মহানবী সা. দেড় হাজার বৎসর আগেই চিকিৎসার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। হাদীসে এসেছে, হযরত খাব্বাব রা. বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূলের কাছে অভিযোগ করলাম এ অবস্থায় যে, তিনি কা’বা ঘরের ছায়ায় একটি চাদরে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বললাম, আপনি কি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করবেন না? জবাবে তিনি বললেন, তোমাদের জানা উচিৎ, তোমাদের আগের মুমিন লোকদের এই অবস্থা ছিল যে, একজন মানুষকে ধরে আনা হতো, তার জন্য গর্ত খুঁড়ে তাকে তার মধ্যে পুঁতে রাখা হতো। অতপর তার মাথার উপর করাত চালিয়ে তাকে দুই খন্ড করে দেওয়া হতো এবং দেহের গোশতের নিচে হাড় পর্যন্ত লোহার চিরুনি চালিয়ে শান্তি দেয়া হতো। কিন্তু এই কঠোর পরীক্ষা তাকে তার দ্বীন থেকে ফেরাতে পারতো না। (বুখারী-৩৬১৬)
১২. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করতে হবে:
উদভুত সমস্যার ব্যাপারে যিনি অভিজ্ঞ তার সাথে পরামর্শ করলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে। নির্ভরযোগ্য আলেমের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি পরামর্শ কামনা করে সে অকৃতকার্য হয়না। (ইবনে হিব্বান- ৭৬৮)
১৩. মাসনুন দোয়া পাঠে মনোযোগী হতে হবে:
আমাাদের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে অনুশীলনের জন্য নবীজির শিখানো মাসনুন দোয়া রয়েছে; আমরা সেগুলো অমলের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি অর্জন করতে পারি। বিশেষ করে এই দোয়া খানি, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আয়ুজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি,ওয়াল আজযি ওয়াল কাছালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া দ্বলয়িদ দাইনি, ওয়া গালাবাতির রিজালি।”
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দূ:চিন্তা ও দূ:খ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপনতা ও ভীরূতা থেকে, ঋণের ভার ও মানষের দমন- পীড়ন থেকে। (বুখারী-২৮৯৩)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুসরন করে দূ:চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে মানসিক প্রশান্তি অর্জনের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়ব আলী, কামিল, (হাদীস); এম,এ (ইসলামিক স্টাডিজ)
অবসরপ্রাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।