একটি মহামারী এবং তার পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিয়েছে। এবং এর পর থেকেই নানা ধরনের উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। যুদ্ধ পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য এবং সেই পরিবর্তন মানব সভ্যতার জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দাভাবে বড় অর্থনীতির দেশগুলোরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যুদ্ধ পৃথিবীকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দেয়নি এবং বর্তমানে যে অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে সেখানেও যুদ্ধ কিছুই দিতে পারেনি। পৃথিবীতে যে একটি সাম্যতা ও ন্যায়ের লক্ষ্য ছিল এবং তার ভিত্তিতে আদর্শিকভাবে একটি দারিদ্রতামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা তা যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে বিনষ্ট হয়েছে। দেশের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্ব সেই দেশকে বহুমুখী সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যুদ্ধ আসলে মানব সভ্যতাকে কোনোদিনই ভালো কিছু দিতে পারেনি। যা দিয়েছে তা হলো মানবিক যন্ত্রণা যা দীর্ঘমেয়াদে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ভোগ করছে। দিয়েছে অশান্তি যার আগুনে পুড়েছে পুরো মানব সভ্যতা। অসংখ্য মানুষ তাদের বাস্তুচুত্য হয়েছে। তারা আজ আশ্রয়হীন হয়ে পরাধীন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ তাদের দায় কেউ নিচ্ছে না। সম্প্রতি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বলেছে, ২০২৩ সালের মধ্যেই মন্দায় পড়বে ব্রিটেন। মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়াবে কমপক্ষে শতকরা ১৩ ভাগ। বিভিন্ন দেশ এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি। সবাই চাইছে পৃথিবী থেকে এ উত্তেজনা প্রশমিত হোক। শান্তির ধারা ফিরে আসুক। কিন্তু বাস্তবে এর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর এবং এ প্রেক্ষিতে এশিয়া জুড়েই বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ হলো কোনো চূড়ান্ত পরিণতি এবং এর জন্য জড়িত উভয় পক্ষ ছাড়াও বহু দেশকে ভোগ করতে হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট (আসিয়ান) সতর্ক করে বলেছে, যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে হিসাব-নিকাশে ভুল হওয়া, গুরুতর বিরোধ, সরাসরি সংঘাত এবং অনিশ্চিত পরিণতিন শঙ্কা রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশি^ক ক্ষমতায়নের একটি নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। একক ক্ষমতায়নের সময়কাল থেকে বেরিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র ব্যবস্থার পালাবদল ঘটার ইঙ্গিত দিতে চলেছে। যার সম্প্রতি ন্যান্স পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে সেই উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা তৈরি হয়। বিশে^ নতুন করে অস্থিরতার তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর কেন্দ্র করে শুরু থেকেই ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয় উভয় দেশের মধ্যে। গত কয়েক বছরের মধ্যে দুই পরাশক্তির উত্তেজনা চরমে পৌছে যায়। বাণিজ্য যুদ্ধের সময় এবং করোনার উৎসস্থল নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়েছিল। কিন্তু এখন অবস্থা যুদ্ধাবস্থায় পৌছে যায়। এখন ইস্যু তাইওয়ান। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও ১৯৭৯ সালের তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট অনুযায়ী, দেশটি দ্বীপ অঞ্চলটিকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। পেলোসির বিতর্কিত সফরের ঠিক আগে তাইওয়ান থেকে চীনা মূল ভূখন্ডে বিভক্তকারী সীমারেখায় চীন যুদ্ধবিমানও পাঠায়। চীনা বাহিনী ঐ এলাকায় তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার করে সামরিক মহড়াও চালিয়েছে। এটা যে চীনের একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না তা জানান দিতেই এতকিছু। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন বরাবরই এই অবস্থানে। গত সপ্তাহে তাইওয়ান প্রণালীতে বড় ধরনের সামরিক মহড়া চালিয়েছে চীন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, আগস্টে মাঝামাঝিতে ইয়েলো সি এর সামরিক মহড়া শেষ হলেও বোহাই সিতে মহড়া চলবে এক মাস। অপরদিকে চীনের মেরিটাইম অথরিটি সামুদ্রিক এলাকায় নতুন করে মহড়ার ঘোষণা দিয়েছে। চীনের এ ধরনের মহড়ায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তাইপে। বিষয়টিকে এ অঞ্চলে হামলার পরিকল্পনার অংশ বলে মন্তব্য অভিযোগ করেছেন তাইওয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ উ। এর মধ্যেই সিএনএন এর খবরে জানা যায়, ভারতের সাথে একটি যৌথ সামরিক মহড়ার অংশ নেবে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে ভারতের বিতর্কিত সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটারের কম দুরত্বে আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এই সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হবে।
সম্প্রতি সীমান্তে অবস্থিত প্যাংগাং সো হ্রদে চীনের একটি সেতু নির্মাণের ফলে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। গত সপ্তাহ জুড়েই চীনের তাইওয়ানে হামলার সম্ভাবনার কথা সামনে চলে এসেছিল। এখনও সেকথা আলোচনায় রয়েছে। সামরিক শক্তির বিচারে চীন বহু যোজন দূর এগিয়ে রয়েছে। ফলে হামলা হলে তা কোন পরিস্থিতিতে মোড় নিবে তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে যা শেখার তা হলো বহু পিছিয়ে থেকেও ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছে। আর ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলো। তাইওয়ানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান নিয়ে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। আর তাছাড়া তাইওয়ানও সম্ভাব্য হুমকি বিবেচনায় সম্প্রতি নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। চলতি বছর নিজেদের বার্ষিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে ৫০০ তে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও যুদ্ধ বাঁধার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিশ^ কি সত্যিই আরও একটি যুদ্ধ দেখতে আগ্রহী? অথবা যদি সত্যিই যুদ্ধ লাগে তখন এশিয়াসহ পুরো বিশ^ যে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হবে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ একটি যুদ্ধ কি ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এই বিশ^। কোনো দেশই সেই বিরুপ পরিস্থিতি এড়াতে পারেনি।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে নতুন নয় কিন্তু যুদ্ধের ফলে পৃথিবীজুড়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার অভিজ্ঞতা একটু নতুনই বলতে হবে। কারণ হলো, করোনাভাইরাসের মতো একটি অতিমারী পার দিয়েই এভাবে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়নি। এখন একইসাথে পৃথিবীকে যুদ্ধের সংকট এবং করোনাভাইরাসে প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ অংশের মেরামত করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আরও একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি পৃথিবী সামাল দিতে পারবে না। তখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পরপর জ¦ালানী তেলের মূল্য বিশ^বাজারে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ^ অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবে দরিদ্র দেশগুলোই বেশি ভুগছে। এর ফলে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন,খাদ্য সংকট এবং ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পরপর জ¦ালানী তেলের মূল্য বিশ^বাজারে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে পৃথিবী সামলে উঠতে সক্ষম হলেও বৈশি^ক বাজারের সাথে রাশিয়ার-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশে^র মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা সম্ভব না। কারণ কোনোভাবেই যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তারপর আবার তাইওয়ান-চীনের উত্তেজনা ঘিরে বিশ^ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নিত্যনতুন সমীকরণ গড়ে উঠছে ক্ষমতায়নের বিশে^। ফলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরও অনেকদিন হয়তো এই অবস্থা বিরাজ করবে। এ সময়টুকুতে দক্ষতার সাথে সামাল দেওয়া হবে চ্যালেঞ্জের। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ^ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং কেউ তার নিজের নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে সম্মত নয়। আজ বিশ^ এক মহা সংকটের সামনে দাড়িয়ে রয়েছে এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐক্যমত অত্যন্ত জরুরী, তা সত্ত্বেও কিন্তু বিশে^ অস্থিরতা বিরাজ করছে।
অলোক আচার্য
প্রাবন্ধিক ও মুক্তগদ্য লেখক, পাবনা।
মোবাইলঃ ০১৭৩৭ ০৪৪৯৪৬