বিশ্বের সব শ্রমজীবি মানুষের শ্রমের মূল্য ও ন্যায্য পাওনা বুঝে পেতে অনেক আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে যুগে যুগে।
আর তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৪ সাল থেকে প্রায় অধিকাংশ দেশ সর্বসম্মতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে ১ লা মে মহান মে
দিবস বা শ্রমজীবি দিবস পালন করে। যার প্রতিপাদ্য বিষয় হল শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা। তবে এই ঘটনার
পেছনের কাহিনী আমরা অনেকেই জানি না। চলুন জেনে নেই কিভাবে শুরু হল মে দিবস, আর কেন পালিত হয় মে
দিবস তার আদ্যপান্ত সব।
কিভাবে শুরু হল মে দিবস?
আমেরিকার শিকাগোর হে মার্কেটের সামনে একদল শ্রমিক ১৮৮৬ সালে সমবেত হয়। তাদের এই সমাবেশে শ্রমিকদের
৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে তারা আন্দোলন করে। কিন্তু হঠাৎ কারা যেন পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে। আর তাই পুলিশ
আত্মরক্ষায় উল্টো গুলি ছুড়ে। আর এতে প্রাণ যায় প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৯ সালে
প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কংগ্রেসের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যেখানে বলা হয় ১৮৯০ সাল
থেকে আমেরিকার শিকাগোরএই ঘটনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দিবস উৎযাপনের কথা। আর এই প্রস্তাবটি উপস্থাপন
করেন রেমন্ড লাভিন। তারই ফলস্রুতিতে ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে এই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এর
পরেই ঘটে যায় ১৮৯৪ সালের মে মাসের বিশাল এক দাঙ্গার ঘটনা।
আর এই সকল ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে ১৯০৪ সালে সমাজতান্ত্রিক দলের মহা সম্মেলনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। যাতে বলা
হয় দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারিত করে দেয়া হয়। আর শ্রমিকদের অধিকার, আন্দোলনের, ও শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা
জানতে ১ লা মে তে শোভাযাত্রা ও র্যালির মাধ্যমে দিবসটি উৎযাপন করার প্রস্তাবনা করা হয় আন্তর্জাতিকভাবে। আর
এভাবেই শুরু হয় মহান মে দিবসের পথ চলা।
কারা পালন করে এই দিবস?
মেহনতি ও শ্রমজীবি সকল মানুষ পালন করে এই দিবসটি। এই দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে শ্রমজীবি সংঘটন এর দাবির
প্রেক্ষিতে বিশ্বের অনেক দেশ ১ লা মে সাধারন ছুটি ঘোষণা করেছে। চীন, কিউবা সহ অনেক কমিউনিস্ট দেশে এই
দিনকে ঘিরে বিশেষ কুচকাওয়াজও অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের প্রায় ৮০ টির বেশি দেশে এই মহান মে দিবস পালিত হয়।
তবে আমেরিকা ও কানাডা এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। শিকাগোর হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পরবর্তীতে আমেরিকার সরকার
প্রধান গ্রোভার ক্লিভ্ল্যান্ড এক সিদ্ধান গ্রহণ করেন। তিনি ও তার সভাসদরা চিন্তা করেন ১ লা মে তে যেকোন আয়োজন
বা অনুষ্ঠান শ্রমিকদের তাদের ক্ষয় ক্ষতির কথা মনে করে দিবে। আর তাই তারা ১৮৮৭ সাল থেকে সেপ্টেম্বরে শ্রমিক নাইট
পালনে উদ্যোগী হয়। যা প্রচলন করে তৎকালীন শ্রমিক ইউনিয়ন এর কেন্দ্রীয় সংগঠন। আর এভেবেই তারা তখন থেকে
সেপ্টেম্বরে শ্রমিক দিবস আয়োজন করে।
কিভাবে পালন করা হয় এই দিনটি?
নানা র্যালী ও সভা সমাবেশের মাধ্যমে উৎযাপিত হয় এই দিন্টি। যেখানে সকল শ্রমিক তাদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করে।
আর তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক সংগঠনরা উৎযোগী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে এই দিনটি
পালিত হয় উৎসব মুখর পরিবেশে। এই দিনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বর্গ বাণী দিয়ে থাকেন। নানা
সামাজিক আয়োজন, সভা, র্যালীর মাধ্যমে সব শ্রমিক সংগঠন, তাদের নেতা ও কর্মীরা এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখে। আর
তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে জাগ্রত হয়।
প্রতিবছর বাংলাদেশে মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। তারই অংশ হিসেবে ২০২১ এর
প্রতিপাদ্য ছিল \”মালিক -শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিব বর্ষে গড়ব দেশ\”।
এছাড়াও আমাদের এই দিনটি ঘিরে নানা গান ও কবিতার সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে একটি গান খুব মুখে মুখে প্রচলিত হয়। কাজী
নজরুলের এই গানটি যদিও ভিন্ন আংগিকে রচিত হয়। তার পরো স্বাধীনতার পরবর্তীতে তার \”কারার ঐ লৌহ কপাট\”
মে দিবসের গান রুপে পরিচিত হয় বেশি। তারই কিছু লাইন হলঃ
কারার ঐ লৌহকপাট,ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাটশিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশানউড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।
গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক?কে সে রাজা?
কে দেয় সাজামুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?
এই গানে শ্রমিকরা তাদের অধিকার সংগ্রামের কথা স্মরণ করে। আর উৎসাহিত হয় অধিকার আদায় ও তা সুরক্ষায়।
আশাকরি ১ লা মে দিবসের সূচনা আর তার কাহীনি সম্পর্কে আপনারা বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। আর এর মাধ্যমে সচেতন
হবেন শ্রমের ও শ্রমিকের। এছাড়াও আপনারা পড়তে পারেন আমাদের বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দিন মুজিবনগর দিবস সম্পর্কে।
আর এভাবেই ইতিহাস সমন্ধে সচেতনতায়ই গড়ে তুলবে এক সুন্দর ভবিষৎ।