\”ডাব লিবেন লন ছার। ভিত্রে ডাবের পানি পাইবেন, শাঁসও পাইবেন, ডাবের দাম কিন্তু বাড়ছে আগেই কইয়া থুইলাম!\”
এই কথাগুলো শুনে কিছু ধারণা করতে পারলেন? হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। এখানে তৃষ্ণা মেটানো ডাবের পানির ব্যাপারে বলা হচ্ছে।
তবে ডাবের পানি শুধুই যে তৃষ্ণা মিটিয়ে তৃপ্তি দেয়, এমনটা নয়। এর গুণাগুণ স্বাস্থ্যকর এবং উপকারী বৈশিষ্ট্যে ভরপুর।
কচি ডাবের পানি হলো ডাবের ভেতরকার রস। ডাব পরিপক্ক হয়ে নারিকেলে রূপান্তরিত হবার সাথে সাথে ডাবের পানি বা জল কমে যায়, আর এই জায়গা দখল করে নারিকেলের শাঁস। তবে ডাবওয়ালা অনেক সময় যে ডাব খেতে দেয়, তাতেও তো শাঁস থাকে। তবে কি তা ডাব নয়?
অবশ্যই, এটাও ডাব। তবে একেবারে কচি ডাবের তুলনায় কিছুটা পরিপক্ক। তাই এর ভিতরে অল্প পরিমাণে শাঁস থাকে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে নারিকেলের গাছের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি পানীয় হিসাবে ডাবের পানি জনপ্রিয়তাও বেশ।
ডাবের ভেতরে পাইপ দিয়ে টাটকা, ক্যানে ভরা, অথবা বোতলে ভরে ডাবের পানি বিক্রি করা হয়।
ডাবের পানিতে প্রতি ১০০ গ্রামে ১৬.৭ ক্যালোরি তথা ৭০ কিলো জুল পরিমাণ শক্তির যোগান রয়েছে। শুধু তাই নয়, ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ আছে। ১ কাপ ডাবের পানিতে যে পরিমাণ খনিজ পদার্থ আছে, তা বেশিরভাগ স্পোর্টস ড্রিংকের চাইতেও বেশি উপযোগী।
অবাক করা আরেকটি বিষয় হচ্ছে, একটি ডাবে একটি কলার চাইতে বেশি পটাশিয়াম থাকে। যেসব দেশে স্যালাইন পাওয়া দুষ্কর, সেখানে ডাবের পানিকে অনেক সময় স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে শিরার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়, যা ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে।
ডাবের পানির পুষ্টিসমৃদ্ধ উপাদানের গণনা করলে, তা যেকোন সফট ড্রিংস কোলড্রিংস বা পানীয়কে হার মানাবে। ডাবের পানিতে শতকরা ৯৫.৫ ভাগ পানি, ০.০৫ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.৫৬ ভাগ ফসফরিক অ্যাসিড, ০.২৫ ভাগ পটাসিয়াম আছে। একই সাথে ডাবের পানিতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড, লৌহ, চিনি এবং আশঁ রয়েছে।
পুষ্টিগুণ এবং তৃষ্ণা মেটাতে এটি উপাদেয়, অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো বিষয়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে অথবা কাজ শেষে শরীর যখন ক্লান্ত, তখন খুব দ্রুত প্রশান্তি এনে দিতে পারে ডাবের পানি। এটি এমন একটি প্রাকৃতিক পানীয়, যাতে কোন কৃত্রিম রং, প্রিজারভেটিভ, ফ্লেভার—এর কিছুই থাকে না এবং এতে সঠিক পরিমাণ পুষ্টিগুণ রয়েছে। তাই বাজারের যত প্রকার কৃত্রিম পানীয় আছে, তাদের মধ্যে ডাবের পানি নিঃসন্দেহে সেরা।
যাইহোক, ডাবের পানির উপাদান সম্পর্কে তো কথা হলো এবার আসুন জেনে নেই ডাবের পানির উপকারিতা এবং আপনি কেন ডাবের পানি পানের অভ্যাস গড়ে তুলবেন।
ডাবের পানির উপকারিতা
ত্বকের জন্য ডাবের পানি
ডাবের পানি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার শরীরে প্রশান্তি এনে দেবে এবং শরীরের পানির অভাব পূরণ করতে ও খনিজ পদার্থের ভারসাম্য রক্ষা করতে ডাবের পানির বিকল্প পাবেন না। দেহের ত্বকে প্রবেশ করে ক্ষতিকর ফ্রি-র্যাডিক্যাল উপাদান, দেহের বিভিন্ন কোষ ধ্বংস করে। ডাবের পানির অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ফ্রি-র্যাডিক্যাল প্রতিরোধ করে, আপনার দেহের কোষ ধ্বংসের হার কমাবে। ডাবের পানিতে উপস্থিত অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টিস, ত্বকের দাগ ও বলিরেখা দূর করে এবং ত্বককে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম থাকায় ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। একইসাথে,এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং প্রাকৃতিক মিষ্টির উপস্থিতির জন্য ক্ষতিকর প্রভাব থাকে না। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডাবের পানি উপকারী।
কিডনি ভালো রাখতে
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ডাবের পানি কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে সাহায্য করে। ডাবের পানি কোলেস্টরেলের মাত্রা কমাতে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
খনিজ উপাদান
প্রচুর পটাশিয়াম এবং খনিজ উপাদান থাকে, যা রক্তচাপ কমাতে ও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। তাই আপনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী হয়ে থাকলে, নির্দিধায় ডাবের পানি খেতে পারবেন এবং এতে আপনার হার্টের কোন ক্ষতি হবে না। তাছাড়া, ডাবের পানিতে অ্যান্টি-থ্রমবোটিক কার্যকারিতা থাকায় এটি রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যাও প্রতিরোধ করবে।
মাথা যন্ত্রণা বা হিট স্ট্রোকের প্রতিষেধক
অধিকাংশ সময়েই ডিহাইড্রেশনের কারণে মাথা যন্ত্রণা বা মাইগ্রেনর অ্যাটাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। এমন সময়ে দ্রুত এক গ্লাস ডাবের পানি আপনার জীবন রক্ষাকারী মহামূল্যবান টোটকা হতে পারে। আসলে এই প্রকৃতিক উপাদানটিতে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়াম, এই ধরনের শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শরীরে পানির ঘাটতি দূর করতে ডাবের পানি
ডাবের পানি শরীরের প্রবেশ করা মাত্র কোষের পানির ঘাটতি মিটতে শুরু করে এবং কোষকে সতেজ করে। ডাবের পানিতে উপস্থিত ইলেকট্রোলাইট কম্পোজিশান ডায়ারিয়া, বমি এবং অতিরিক্ত ঘামের পর শরীরে ভিতরে খনিজের ঘাটতি মেটাতে বিশেষ কার্যকরী হিসেবে সমাদৃত। সেই কারণেই তো গরমকালে বা ডিহাইড্রেশনের চিকিৎসায় ডাবকে রোজকার সঙ্গী করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।
এছাড়াও দেহে ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাব হলে এবং বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ হলে অধিকাংশ ডাক্তার ডাবের পানি পান করার পরামর্শ দেন৷ কারণ ডায়রিয়া বা কলেরা রোগীদের ঘনঘন পাতলা পায়খানা ও বমি হলে দেহে প্রচুর পানি ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি দেখা যায় অর্থাৎ ডিহাইড্রেশনে ভুগতে দেখা যায় ৷ খনিজ উপাদানের এই ঘাটতি ডাবের পানি অনেকাংশেই পূরণ করতে পারে৷
হার্টের চিকিৎসায়
ডাবের পানিতে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম পরিমিত পরিমাণে থাকে, যা হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম ঠিক রাখে এবং হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য কোলেস্টরলের মাত্রা বৃদ্ধি খুবই বিপদজনক তবে সুখবর হলো ডাবের পানি ক্লোরেস্টেরলের মাত্রা কমাতে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ডাবের পানি পানে সতর্কতা
অনেক সময় আমরা না বুঝেই আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলো গ্রহণ করে থাকি। এক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ কথায় আছে \”উনো ভাতে দুনো বল, অতি ভাতে রসাতল\” অর্থাৎ পরিমিত আহার এই অধিক শক্তি এবং অতিরিক্ত আহারে পন্ডশ্রম, যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে সুতরাং আপনাকে কিছু বিষয় খেয়াল রেখে ডাবের পানি পানের অভ্যাস করতে হবে।
আপনার যদি কিডনির রোগ বা রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে আপনি সপ্তাহে তিন দিন এক গ্লাস করে ডাবের পানি খেতে পারেন। তবে যেদিন ডাবের পানি খাবেন, সেদিন পটাশিয়াম আছে এমন ফলমূল বা খাবার কম পরিমাণে খাবেন। এতে আপনার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। কারণ ইতিমধ্যেই আপনি জেনেছেন যে, ডাবে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। আর অতিরিক্ত পটাশিয়াম আপনার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক করার বদলে উল্টো হার্টের ক্ষতি করবে।
স্বাভাবিক মৌসুমে বা গরমে একজন সুস্থ ব্যক্তি নিয়মিত এক গ্লাস ডাবের পানি পান করতে পারেন, যা আপনাকে সুস্থ ও সতেজ থাকতে সাহায্য করবে। তবে এক্ষেত্রে প্রথমে আপনার বডি চেকআপ ( রক্তচাপ, রক্তে ক্লোরেস্টেরলের মাত্রা, গ্লুকোজের পরিমাণ, পটাশিয়ামের মাত্রা ইত্যাদি) প্রয়োজন।
শেষ কথা
ডাবের পানির উপকারী গুণ গুলোর তুলনায় অপকারিতা অনেক কম। তাছাড়া সবার শারীরিক গঠন এক হয় না, যে কারণে অনেকের ক্ষেত্রেই ডাবের পানি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে (যেমন হজমে সমস্যা, গ্যাস্টিক)। তবে বেশিরভাগ সময় রূপচর্চায়, অতিথি আপ্যায়নে ডাবের জলের বিপুল ব্যবহার দেখা যায়। পাশাপাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ সারাতে, দুর্বলতা কাটানোর মহৌষধ হিসেবে বা ডায়েট চার্টে হরহামেশা ডাবের জলের দেখা মেলে।
তাই আপনার স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকায় ডাবের পানি রাখতে পারেন। এছাড়াও আপনার দেহের জন্য ডাবের পানির উপকারিতার গল্প শেয়ার করতে পারেন আমাদের সেবারু ডট কম এ কমেন্টের মাধ্যমে। ধন্যবাদ, সুস্থ থাকুন, সুন্দর জীবন উপভোগ করুন।