ভার্সিটিতে-ফার্স্ট-ইয়ারে

প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে স্বস্তি ও শান্তি হচ্ছে নিঃশর্তভাবে দিয়ে যাওয়া, দান করে যাওয়া; তাতে প্রেম সার্থক-সমার্থক ও সমৃদ্ধ হয়।
প্রেমের প্রকৃত সুখ পাওয়াতে নয়, দেয়াতে। পরার্থে সর্ববিসর্জন দিয়েই প্রেম-ভালোবাসার অমিয় সুধা আহরণ করতে হয়।
কোথায় যেন ইংরেজিতে একটি কথা পড়েছিলাম The greatest satisfaction in a life, lies in giving satisfaction to others.
শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের বাণী দিতে যে পারে না, পাওয়া তার ঘটে না।

তাই আমি মনে করি প্রেমের ক্ষেত্রেতো বটেই, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই দান করতে হবে আগে, তারপর অন্যের কাছে প্রত্যাশা। অনেকটা ব্যবসায়ে বিনিয়োগের মতো। পুঁজি জোগাড় করবেন, খাটাবেন বা লগ্নি করবেন, ব্যাংক একাউন্ট-লাইসেন্স-ট্যাক্সসহ বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন ও দায়-দেনা পরিশোধ করে সকল পক্ষকে তুষ্ট করতে পারলে তারপরইতো লাভের প্রত্যাশা। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। আগে স-ব দেবেন, তারপর পাবেন। অর্থাৎ প্রথমে নিজ থেকে দিতে থাকবেন কম্প্রোমাইজ, কনসিডারেশন, স্মার্টনেস, ধৈর্য, ক্ষমা, যৌক্তিক ও কল্যাণ চিন্তার আকর্ষণীয় আচার-আচরণ। কেবল তারপরই অন্যের কাছ থেকে ভালোবাসার প্রত্যাশা করতে পারবেন নিজের ভেতরে।
এককথায় অন্যের মনোরাজ্যে আপনার প্রতি এমনই কৃতজ্ঞতাবোধ, এমন এক আকর্ষণ তৈরি করবেন যাতে তার অজান্তেই সে গাইতে শুরু করে আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য তোমারি প্রেমের জন্য…।

ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তির যুক্তিহীন কথাবার্তা প্রেমের পথে বিরাট অন্তরায়। তাছাড়া স্বার্থপরতাও প্রেমে অন্তরায়। স্বার্থপরতার মধ্যে আর যাই থাকুক, প্রেম থাকে না। সে কারণে নিজে ‘আনিস’ হয়ে অন্যকে ‘দেনিস’ আশা করলে তথা সর্বক্ষণ হাত পেতে রাখলে প্রেম-ভালোবাসা পাওয়া যায় না। প্রথমে হাত উপুড় করতে হবে, উজাড় করতে হবে; প্রথমে ভালোবাসতে হবে, ভালোবেসে যেতে হবে; ভালোবাসার স্বভাব তৈরি করতে হবে। ভালোবাসা দেখানোর স্বভাবে না গিয়ে বরং প্রকৃত ও প্রাকৃত ভালোবাসার স্বভাব অর্জন করতে হবে। তারপরই কেবল পাওয়া যাবে অপরের ভালোবাসা। তখন দেখা যাবে অন্যের ভালোবাসার জোয়ার। এভাবে অন্যের মধ্যে নিজের প্রতি ভালোবাসা উৎপাদন না করে যদি ভালোবাসা চাওয়া হয়, তাহলে তা পাওয়া যাবে কোত্থেকে!

প্রেম-ভালোবাসার কারখানা ও প্রেম উৎপাদন

প্রেম-ভালোবাসার উৎপাদন আবার কী বিষয়? এ প্রশ্নটি নতুন হলেও এর উত্তর একদম সহজ। নিজকে নানা জ্ঞানে ও গুণে গুণান্বিত, সৌন্দর্যমন্ডিত ও আকর্ষণীয় করে তুললেই আপনি হয়ে উঠবেন প্রেম-ভালোবাসার কারখানাস্বরূপ। এরূপ কারখানারূপে গড়ে উঠলে আপনার চিন্তা ও মনন থেকে ভালোবাসা উৎপাদিত ও উৎসারিত হয়ে তার স্ফূরণ ঘটবে চতুর্দিকে। স্বর্গীয় প্রেম-ভালোবাসার মঙ্গল আলোকে জ্যোতির্ময় হবে সর্বদিক। আপনার মনোরাজ্য তথা আপনার ইন্ডাস্ট্রি থেকে ভালোবাসা অন্য মনে সঞ্চারিত হয়ে সেখানেও গড়ে উঠবে ভালোবাসার ইন্ডাস্ট্রি। সে ইন্ডাস্ট্রিতে উৎপাদিত ভালোবাসার প্রাচুর্যে ঐ মানুষটি এবং আপনি উভয়েই হয়ে উঠবেন উদ্ভাসিত, স্বর্গীয় সুখে উদ্বেলিত। এভাবে নিজের মধ্যে প্রেম উৎপাদনের ফলে সঙ্গীর ভালোবাসা অর্জনের পাশাপাশি সৃষ্টিজগতের সবার ভালোবাসা এমনকি স্রষ্টার আনুকূল্যও পাওয়া সহজ হয়ে যায়।
প্রেম-ভালোবাসার উৎপাদন ও বিতরণে আপনি হবেন সুবিশাল গাড়ির ছোট্ট একটি ব্যাটারির মতো। স্টার্ট নেয়ার সময় ব্যাটারি থেকে একটুখানি চার্জ নিয়ে তারপর গাড়ি চলতে থাকে অবিরাম। গাড়ির উদ্দাম চলার সময়ে ব্যাটারির আর কোনো কাজ নেই বটে, কিন্তু গাড়ির চলার শুরু ঐ ব্যাটারির শক্তি দিয়েই। এরপর চলার সময়ে গাড়ি নিজেই শক্তি উৎপাদন করে নেয় এবং ব্যাটারি থেকে যে সামান্য শক্তি সে নিয়েছিল, তার বহুগুণ তাকে ফেরত দিতে সক্ষম হয়ে ওঠে। এভাবে গাড়ির ব্যাটারির শক্তি উৎপাদন ও বিতরণের মতোই প্রেম-ভালোবাসা উৎপাদনী কারখানা আপনিও গড়ে তুলতে পারেন প্রথমে আপনার নিজের মধ্যে, তারপর আপনার কাক্সিক্ষত পাত্র বা পাত্রীর মধ্যে।
এভাবে আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্ম-উন্নয়নের মাধ্যমে প্রেমতো পাওয়া গেল; তারপর কি অবহেলা? জ্বি না! বরং দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল। প্রেম ও ভালোবাসায় চর্চা ও সেবা কিন্তু প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের। প্রাত্যহিক সেবা ও মননের উষ্ণ স্পর্শে একে ধরে না রাখলে Highly sensitive এ প্রেম টিকে থাকে না। কারণ Love is like a tree; it needs water, fertilizer, light, heat, touch of humanity etc. Without these it may remain alive, but it will not be a healthy tree nor it will give nice fruits or flowers.

প্রেমে সাফল্য ও ব্যর্থতা

প্রেমে সাফল্য ও ব্যর্থতার দিক যেমনি উপেক্ষিত নয়, তেমনি সে সাফল্য বা ব্যর্থতার স্বরূপ উন্মোচনও সহজসাধ্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে ‘আমি’ এবং ‘প্রেম’ এ দু’টো বিষয়ের অস্তিত্ব চিরন্তন। আমি মানে আমার আত্মা বা যার ক্ষয় নেই, লয় নেই, মৃত্যু নেই। তেমনি প্রেমও মৃত্যুহীন এক অবিনশ্বর শক্তি।
আত্মা ও প্রেম Ñদু’টিই এক অক্ষয়ী-অব্যয়ী শক্তি; যার মৃত্যু নেই, জন্মান্তর নেই; যা কিছুতেই হনন করা যায় না, আগুনে জ্বলে না, রোদে পোড়ে না, জলে ভেজে না। এরূপ শক্তির কোনো রূপান্তর নেই, তাই প্রেম ও আত্মার বিনাশ বা পুনর্জন্মের ধারণা অবান্তর। সত্য ও শক্তি যেরূপ ছিল-আছে-থাকবে, প্রেম এবং আত্মা সেরূপ ছিল-আছে-থাকবে।
অধিকাংশ মানুষ মৌলিক সত্য (Basic truth) থেকে দূরে থাকে বলে এরূপ সত্যকে ভয় পায়; সত্য ও প্রেমকে অস্বীকার করে দূরে ঠেলে দেয়; হয়ে পড়ে প্রেমহীন, পরিণত হয় অসহায় মানুষরূপী এক অসাড় জীবে।
প্রেম-ভালোবাসার জন্য যে সুন্দর-সচেতন-সুনিয়ন্ত্রিত ও স্বশিক্ষিত মন দরকার, তা অনেকের মধ্যে থাকে না বলে দোষ দেয়া হয় প্রেমের, বলা হয় ‘ব্যর্থ প্রেম’। আসলে প্রেম কখনো ব্যর্থ হয় না, ব্যর্থ হয় প্রেমিক অথবা প্রেমিকা। অসুন্দর ও অনিয়ন্ত্রিত মন আর অশিক্ষা-কুশিক্ষার কারণে প্রেমানলে পুড়ে ধুকে ধুকে মরে তারা। প্রেম সম্পর্কে তাদের শেষ কথা বা উপসংহার থেকে যায় এভাবেÑ প্রেম একটি জলন্ত সিগারেট; শুরু হয় অগ্নিতে আর শেষ হয় ছাইয়ে।
তাইতো যে প্রেম সম্মুখে চলতে ও চালাতে জানে না, সে প্রেম জড়-স্থবির। সে প্রেম মানুষকে নিষ্ক্রিয় ও নিষ্প্রাণ করে তোলে, স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়ে আয়ুক্ষয় করে দেয়। এরূপ যাতনাময় প্রেমের চেয়ে বিষাদের নিঃসঙ্গতাই শ্রেয়। কারণ যে আগুন কেবল দহন করে অথচ এতটুকুন আলো দেয় না, সে আগুন জ্বালিয়ে রেখে কী লাভ?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *