ফুল ক্যাপশন

ফুল ক্যাপশন, কবিতা ও নানা কথা

ষাট দশকে যখন উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাশে পাঠ্য বইয়ের আওতায় ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ড্যাফোডিল কবিতা পড়তাম; তখন কবির বর্ণনায় এই ফুল সম্পর্কে নানা বিষয় আমাকে বেশ স্পর্শ করতো এবং একই সঙ্গে বেশ কৌতুহল সৃষ্টি করতো। অবশ্য শৈশব কাল থেকেই ফুলের প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ ছিল।

যাহোক, ১৯৮৪ সালে যখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ মিলে যায়। তখন তো বলতে গেলে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেয়ে যাই। কেননা কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেই বিলেতেও আছি এবং যুগপৎ বিভিন্ন আঙ্গিকে সেখানকার রাস্তার পাশের্^, বাগান ও ক্ষেতে অজ¯্র ড্যাফোডিল ফুল দেখি এবং হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অবলোকন পূর্বক এতদিনের মনে তৃষ্ণা নির্বারণ করি। ড্যাফোডিল ছাড়াও গোলাপ, ম্যাগনোলিয়া, লিলি, টিউলিপ, পপি, ইত্যাদিও কম দেখেনি? কথা প্রসঙ্গে কবি সতেন্দ্রনাথ দত্তের আট লাইনের সেই ছোট একটি কবিতার কথা মনে পড়ে যায়, যা হলো- “জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি; দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী”।

তাছাড়া ছোটবেলায় কবি বেগম সুফিয়া কামাল কর্তৃক রচিত ফুল নিয়ে একটি কবিতা এখনও হৃদয় পটে দাগ কেটে আছে।

সেটি হলো, “প্রভাত কাননে আজি ফুটিয়াছে ফুল; গোলাপ, চামেলী, বেলী, চাঁপা ও পারুল”।

এতদ্ব্যতীত বিভিন্ন প্রখ্যাত অনেক সঙ্গীতে রাগ- রাগিনীর সারথি ধরে ফুলের ব্যবহার কম হয়নি? এদিকে বাংলা সাহিত্যে শুধু কেন, সব ভাষাতে হৃদয় স্পর্শকারী নিয়ামক হিসেবে নারী, ফুল, পাখী, তরুরাজি, নদ নদী, পাহাড় পর্ব্বত, চন্দ্র সূর্য, তারকারাজি ইত্যাদি আলংকারিক ভাবে হৃদয়ে জায়গা জুড়ে বহমান। এর মধ্যে ফুলের অধিক ব্যবহার প্রণিধানযোগ্য। যাহোক, এর ইংরেজি শব্দ ফ্লাওয়ার যা এসেছে ইতালীর ফুলের দেবী ফ্লোরার ল্যাটিন নাম থেকে। আর বাংলা ভাষায় দুই অক্ষর সম্বলিত ফুল নামটির সঙ্গে ছোট, বড়, আবালবৃদ্ধ বণিতা সবাই আমরা পরিচিত।

ফুলের ব্যবহার

অবশ্য এর প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ কম নয়; যেমন- পুষ্প, কুসুম, রংগন, প্রসূন, কমল, ইত্যাদি। আর ফুলের ব্যবহার শুধু এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কোন সময় উপমা (ঝরসরষব), কোন সময় রুপালংকার (গবঃধঢ়যড়ৎ); আবার প্রতিকীশ্রয়ী (অষষবমড়ৎু) এবং ব্যক্তিরূপে (চবৎংড়হরভরপধঃরড়হ) বর্হিপ্রকাশ কম দেখা যায় না? আসলে ফুল সৌন্দর্য্যরে প্রতীক এবং একই সঙ্গে পবিত্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক। সাধারণত জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, সাফল্য, জয়ন্তি, ইত্যাদিসহ যে কোন উপলক্ষ্যে কাউকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাতে ফুল উপহার হিসেবে দেয়ার কার্যক্রম তুলনামূলক অধিক প্রচলিত। আর সনাতনধর্মে মন্দির বা মন্ডপে ফুল ব্যবহার তো অপরিহার্য অর্ঘ হিসেবে বিবেচিত। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে স্মরণকাল থেকেই ফুলকে সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক বস্তু হিসেবে অভিহিত করা হয়। সনাতন ধর্মে বিশেষ বিশেষ দেব দেবীর আরাধনার নিমিত্ত বিশেষ বিশেষ ফুল ব্যবহৃত হয়। যেমন- শিবের পুজায় ধুতরা, মা কালীর পুজায় জবা ফুল, ইত্যাদি। শুধু সনাতনী ধর্ম কেন? সব ধর্মেই কমবেশি ফুলের সূক্ষ্ম ও স্থুল দিক দিয়ে গুরুত্ব রয়েছে। এই ধরুন শান্তির ধর্ম ইসলামের কথা। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে জান্নাতে বিদ্যমান বেশ কিছু ফুলের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা সুখ-শান্তি ও আনন্দের নিয়ামক। উল্লিখিত বেহেস্তী পুষ্পগুলো হলো, আফনান, এশাল, জুনাইরা, রেহান, আরজি, মেনাল, মিনাটিল, জারা, ইত্যাদি। এদিকে অনেক দেশেই ফুলকে রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। আার ফুল থেকে আহৃত মধুর গুরুত্ব যে কতখানি, তা সবাই কমবেশি অবহিত আছেন। তাছাড়া রেণু/পরাগ (ঢ়ড়ষবহ) এবং মধুর আশে ফুলকে ঘিরে মৌমাছি, প্রজাপতি, ভ্রমর ও ছোট পাখির আনাগোনা বলতে গেলে কবি মন উতালা করে তুলে। আরেকটি কথা, ভালোবাসা তো দেখা যায় না, যা থাকে অনুভবে। কিন্তু এর বর্হিপ্রকাশ ঘটে হৃদয় নিংড়ানোর আতিসয্যের প্রতিভু হিসেবে ফুল দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে। এ প্রেক্ষাপটে জনশ্রুতিতে জানা যায় যে, ভালোবাসা প্রকাশের প্রতীক হিসেবে লাইলাক, সূর্যমুখী, প্রিমরোজ, ক্যামেলিয়া, পিওনি, কারনেশন, ডিপসোফিলা, আর্কিড, ব্লিডিং হার্ট প্রভৃতি ফুলকে ধরা হয়। আর পাশ্চাত্য বিশে^র বিশ^াস যে প্রথম ভালোবাসা (ঋরৎংঃ খড়াব) প্রকাশের প্রতীক হিসেবে থোকা ধরা বেগুনি রংয়ের লাইলাক ফুলগুলোর চেয়ে আর নাকি উত্তম উপহার হয় না ? অবশ্য বর্তমানে প্রেমিক প্রেমিকাগণ গোলাপ ফুলের মাধ্যমে অধিকতর ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকে।

আ) এ বিশে^ অধিকাংশ ফুলই হলুদ, সাদা ও লাল এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেগুনি হয়ে থাকে। কতগুলো ফুল সারা বছর ফোটে। আবার কিছু ফুল মৌসুমী। আর স্থলজ ও জলজ উভয় উদ্ভিদেই ফুল হয়। তবে জলজের চেয়ে স্থলজ উদ্ভিদেই অধিকাংশ ফুল পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। রাত্রে কিছু ফুল ফোটলেও বেশির ভাগ ফুল ফোটে দিনের বেলায়। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের যে জাতীয় ফুল শাপলা, তা জলজ উদ্ভিদ থেকে এবং রাত্রে ফোটে। কিছু ফুলে সুগন্ধি তথা সুবাস নেই, তবে দৃষ্টিনন্দন। আর কিছু ফুলের সুগন্ধে হৃদয় নড়ে চড়ে বসে। আবার কতিপয় ফুল দেখতেও সুন্দর এবং একই সঙ্গে সুগন্ধি ছড়ায়। এতদ্ব্যতীত কিছু ফুল কয়েকদিন ধরে শোভাবর্ধন করে। আর কিছু ফুল একদিনেই ঝরে যায়। সাধারণত ফুলের দুটি প্রধান অংশ, যেমন- অঙ্গজ এবং প্রজনন অংশ। একটি আদর্শ ফুলের চার প্রকারের অংশ বোঁটার উপর অবস্থিত এবং পুস্পাক্ষ নামক অংশের উপর চক্রাকারে বিন্যস্ত থাকে। আর পুষ্পাক্ষের উপর সাজানো চারটি অংশ হলো বৃত্তি মন্ডল , দল মন্ডল, পুংস্তবক এবং স্ত্রী স্তবক। এদিকে আমরা জানি যে, এ বিশে^র ফুল বহু প্রকারের। আর প্রকারভেদ নির্ভর করে এদের আকার-আকৃতি ও রংয়ের সংমিশ্রণের উপর। এতদ্ব্যতীত ফুলের দুটি অত্যাবশকীয় অংশ রয়েছে যেমন- ১) উদ্ভিজ অংশ, যা পাপড়ি ও পেরিয়ান্থে সংশ্লিষ্ট কাঠামো নিয়ে গঠিত এবং ২) প্রজনন বা যৌন অংশ।

ই) এবার আসুন সুজলা সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, পাহাড় বেষ্টিত সবুজ মেঘলা এবং অরণ্যময় প্রকৃতি; যার উত্তরের উচ্চভূমি, মধ্যস্থলের সমভূমি এবং দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী পরিবেস্টিত নি¤œসমতলভূমি বৈশিষ্ট্যের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশের দিকে নজর দেয়া যাক। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় এ সোনার বাংলার বিভিন্ন ঋতুতে নানা রকম ফুল অপরূপ সৌন্দর্যের ডালা নিয়ে আসে। এই বৈচিত্রময় বাংলার গোলাপ, গন্ধরাজ, বেলী, হাছনাহেনা, বকুল, জুঁই, কেতকী, কামিনী, পদ্ম, পারুল, শাপলা, স্থলপদ্ম, চাঁপা, গাঁদা, জবা, কুন্দ, সর্ষে, শিমুল, পলাশ, মাধবী, মল্লিকা, অশোক, দোলনচাঁপা, কাঞ্চন, রঞ্জন, চামেলী, কৃষ্ণচূড়া, কনকচাঁপা, প্রভৃতি পুষ্পরাজি বলতে গেলে বিহঙ্গের কলকাকলির মধুর সুরের আওতায় স্বকীয়তা নিয়ে কিষান কিষানির মনে দোলা দিয়ে যায়। বাংলাদেশের বনে জঙ্গলে হাজারো নাম না জানা ফুলের প্রাচুর্য যেমন রয়েছে; তেমনি এখানে জনসাধারণের প্রচেষ্টায় জন্মে নানা প্রকারের ফুল। উল্লেখ্য যে, বন বাদাড়ে, ঘরের আশেপাশে, গোয়ালঘরের কাছে, পুকুর পাড়ে, বাগানে, নদ নদী তীরে, মেঠো পথ সহ বড় রাস্তার পাশের্^ নানা ধরনের ফুল পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া এর মধ্যে অনেক ফুল স্বতঃফূর্তভাবে জন্মে এবং যেখানেই ঝরে যায়। বাংলাদেশের অতিথিপরায়ণ মানুষ প্রেমে, ভালোবাসায়, পার্বনে, পূজায় ও নানা অনুষ্ঠানে সমভাবে এসব ফুলের ব্যবহার করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, শেক্সপীয়ার বলেছিলেন- “ফুল যে ভালো না বাসে, সে মানুষকে খুন করতে পারে”।

তার এই উক্তিটি বির্তর্কিত হলেও অনেকাংশে সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। যাহোক, ঋতুরাজ বসন্ত আসে মাধবীক্ষণের ফুলের সাজ পড়ে। এ সূত্র ধরে শিমুল, পলাশ, আমের বউল, মাধবী, অশোক, পারুল, কিংশুক, রজনীগন্ধা, হা¯œাহেনা প্রভৃতি ফুলের মেলা বসে এ বসন্তে এবং আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। এদিকে বর্ষায়ও কম ফুল দেখা যায় না? যুঁথী, কেয়া, কদম্ব, মালতি, করবী, শাপলা, ইত্যাদি বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির নূপুরের তালে তালে ফুটে চারদিক সুরভিত করে তুলে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে গ্রীষ্ম ও হেমন্তে তেমন ফুলের সমারোহ না থাকলেও কুয়াশার চাদর গায়ে নিয়ে শীতে বিশেষত বিদেশী ডালিয়া, সূর্যমুখী, সিজন ফ্লাওয়ার, জিনিয়া, প্রভৃতি বাঙ্গালী হৃদয় আঙ্গিনায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে থাকে। অবশ্য কৃষ্ণচূড়া, গন্ধরাজ, গ্রীষ্মকালে এবং গাঁদা, জবা, বেলী, গোলাপ শীতের প্রধান ফুল। আসলে মানুষের ভালোবাসায়, সুখে- দুঃখে, হর্ষ বিষাদে, পূজা পাবর্ণে, প্রেমে ভক্তিতে, রোগ শোকে ও নানা অনুষ্ঠানে এসব ফুল বন্ধুবেশে বাঙ্গালীর সংস্কৃতিতে বড় আসন নিয়ে সুবাসিত দীপ্তি ছড়াচ্ছে। আর ফুলই এমন একটি বস্তু, যার কোন নেতিবাচক দিক নেই; যা একদিকে হৃদয় মনকে সজিব করে তুলে এবং যুগপৎ সৌরভে সুবাসিত করার বিকল্প নেই। তাই বোধ হয় কারো দ্বিমত করার অবকাশ নেই যে “সুন্দর ফুল সুন্দর”।

দ্বিতীয় পর্বে চোখ রাখুন- “ফুল ব্যবসা”।

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।

সহায়ক সূত্রাদি ঃ

১। বাংলা পিডিয়া।
২। ইন্টারনেট।
৩। উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা সম্পাদনা- প্রফেসর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এবং সৈয়দ হাবিবুর রহমান।
৪। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন- ২৯/০১/২০২২, ০৫/০২/২০২২, ০২/০৪/২০২২ এবং ১৬/০৪/২০২২ইং।
৫। দৈনিক প্রথম আলো- ১৪/০৮/২০২২ এবং ২৯/০৯/২০২২ইং।
৬। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *