মহাবিশ্ব কত বড়

মহাবিশ্ব কত বড়? ও এর সৃষ্টি রহস্য কি?: দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব:
পূর্বেই বলেছি যে, কালের পরিক্রমায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং একই সংগে দূর আকাশে পর্যবেক্ষণের জন্য নানা ধরনের অত্যাধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভাবন হয়েছে। কিন্তু যে দু’টি দূরবীক্ষণ যন্ত্র অভাবনীয় গবষেণার জন্যে আমাদের অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে; তা হলো হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়েছে স্যাটেলাইট যুগ। এ সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইট পাঠাতে শুরু করেন এবং যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয় মহাকাশকে জানার নতুন পদ্ধতি। এরই পথ ধরে ১৯৯০ সালের ২৪ শে এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল টেলিস্কোপ। এর মাধ্যমে স্থাপিত হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি স্যাটেলাইট টেলিস্কোপের নতুন যুগ। প্রায় ১৩ মিটার লম্বা এবং ৪ দশমিক ৩ মিটার চওড়া ১১ টন ভরের হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, যা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে দীর্ঘ ৩২ বছর ব্যাপী। প্রতি সপ্তাহে এই টেলিস্কোপ পাঠাচ্ছে প্রায় ১৫০ গিগাবাইট ডেটা। আর এ ডেটা ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে মহাবিশ^ কী হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাছাড়া হাবল টেলিস্কোপের ডেটার সাহায্যে প্রমাণ মিলেছে যে বিশালাকৃতির ব্ল্যাকহোল (ইষধপশ যড়ষব) এবং একই সঙ্গে এটি সন্ধান দিয়েছে অনেক নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা ইত্যাদির বিষয়ে। এদিকে হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যা কম কথা নয় ?

কিন্তু অদম্য জ্ঞানপিপাসু বিজ্ঞানীরা এতে খুশি না থেকে হাবল টেলিস্কোপের যেটুকু কমতি বা দুর্বলতা আছে, সেটুকু দূর করে মহাকাশে আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন অনেক আগে থেকেই। কেননা হাবল পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি ঘুরছে বলে অনেক সময় পৃথিবী নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। তাছাড়া এটি পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সময় ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্টের একটা অংশের কাছ দিয়ে যায় বলে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যন্ত্রপাতিতে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ সৃষ্টি করে, যা প্রয়োজনীয় ডেটা বা উপাত্ত সংগ্রহে বিঘœ ঘটায়। এতদ্ব্যতীত হাবল টেলিস্কোপের ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার অতি দূর নক্ষত্র থেকে আসা ক্ষীণতম আলো থেকে যে ছবি নির্মাণ করে, তা খুবই অনুজ্জ্বল এবং অস্পষ্ট।

এসব ত্রুটি দূর করে বাড়তি অনেক প্যারামিটার সংযোজনপূর্বক নতুন একটি স্যাটেলাইট তথা দূরবীক্ষণ যন্ত্র নির্মাণ করে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, যার নাম জেমস ওয়েব,যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর জ্যোতিবিজ্ঞানে শুরু হয় অভাবনী বিপ্লব। সেদিন পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও অনেক গুণ শক্তিশালী এই জেমস ওয়েব স্পেস নামক নতুন টেলিস্কোপ। তুলনামূলকভাবে যদি বলি, তাহলে উল্লেখ করতে হয় যে, হাবল টেলিস্কোপের সঙ্গে জেমস ওয়েবের গঠনে বেশ কিছু পার্থক্য আছে; যেমন- হাবল টেলিস্কোপের আকার যদি একটি ৫০ সিটের বাসের সমান হয়, যেখানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আকার একটি টেনিস কোর্টের সমতুল্য। আর হাবলের দর্পণের ব্যাস ২ দশমিক ৪ মিটার। অথচ জেমস ওয়েবের দর্পণের ব্যাস ৬ দশমিক ৫ মিটার। এদিকে হাবলে যে ক্যামেরাগুলো আছে, সেগুলো অতিবেগুনি দৃশ্যমান আলো এবং নিয়ার ইনফ্রারেড বা দৃশ্যমান আলো কাছের অবলোহিত আলোর তরঙ্গ শনাক্ত করে ছবি তুলতে পারে। অথচ জেমস ওয়েবের শক্তিধর ক্যামেরাগুলো কাজ করে পুরাপুরি ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোর তরঙ্গে। হাবল টেলিস্কোপ যেখানে পৃথিবী থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। সেখানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে (চাঁদের অক্ষের কাছাকাছি দূরত্বে) এই কারণে জেমস ওয়েবের পক্ষে মহাকাশের অনেক দূরের ভেতরে চোখ রাখাসহ সমধিক প্রসারিত এলাকা পর্যবেক্ষণ সম্ভব। এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এক হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে বানানো হয়েছে। আর এটির বানানোর পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)। আর এটি উৎক্ষেপণ করা হয় ফ্রেন্চ গায়ানা থেকে আরিয়ান ৫ রকেটের সাহায্য এবং বর্তমানে এটি পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরের বিশেষ বিন্দুতে অবস্থান করছে। আর এটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে স্থাপিত স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউড থেকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে জেমস ওয়েবের মূল আয়নাটি ষড়ভুজাকৃতির। এটি ১৮টি ছোট ছোট আয়না মিলে তৈরি। আর এ আয়না সোনার আবরণে মোড়া। অবশ্য দ্বিতীয় আরেকটি আয়না আছে, যেটি মুল আয়না থেকে প্রতিফলিত আলোকে কেন্দ্রীভূত করে ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউলের ওপর এবং গৃহীত আলো থেকে এই মডিউল ছবি তৈরি করে। এখানেই শেষ নয়। এই টেলিস্কোপটিতে আরও আছে স্টার ট্র্যাকার হিসেবে ছোট ছোট কিছু টেলিস্কোপ, যা নক্ষত্রদের প্যাটার্ন খেয়াল রেখে মূল টেলিস্কোপটিকে দিকনির্দেশণা দিয়ে থাকে।

এবার আসুন, এর কার্যক্রম নিয়ে কিছুটা তলিয়ে দেখি। এ প্রসঙ্গ ধরে উল্লেখ্য যে ওয়েবের ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউলে আছে একটি নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা। সত্যি কথা বলতে কি, এটি জেমস ওয়েবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরা। মূলত ৭০০ ন্যানোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে আলো, যা অবলোহিত আলো বলে অভিহিত। আর এ আলো দৃশ্যমান নয়। এদিকে ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে বলে নিয়ার ইনফ্রারেড বা দৃশ্যমান আলোর কাছাকাছি অবলোহিত আলো। তাছাড়া সায়েন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউলে আছে একটি মিড ইনফ্রারেড, যা মাত্র ৭ কেলভিন তাপমাত্রায়ও কার্যকর থাকে। আসলে এটি ক্যামেরা কাম স্পেকট্রোগ্রাফ বা বর্ণালিমাপক যন্ত্র। এর মাধ্যমে মিড থেকে ফার ইনফ্রারেড অর্থাৎ তিন হাজার ন্যানোমিটার থেকে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে অবলোহিত আলো ধরা সম্ভব। তাছাড়া আরও আছে একটি ফাইন গাইডেন্স সেন্সর এবং নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার অ্যান্ড সিটলেস স্পেকট্রোগ্রাফ, যার মাধ্যমে অতি ম্লান নক্ষত্রের আলোকেও শনাক্ত করা যায়। সাধারণত ম্যাগনিচ্যুড সংখ্যা যত বড়, উজ্জ্বলতা তত কম। আর এই তত্ত্বের আলোকে অতি ম্লান নক্ষত্রের আলো শনাক্ত করা হয়ে থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে ফাইন গাইডেন্স সেন্সর পরিস্কার ছবি ওঠাতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া এতে আছে একটি আলাদা নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ, যা একসঙ্গে ১০০টি গ্যালাক্সির বর্ণালি ধারণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। যাহোক, গৃহীত আলো থেকে ছবি তৈরিপূর্বক এসব ছবি ও তথ্য পৃথিবীতে প্রেরণ করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হাই গেইন অ্যানটেনা। আর একটি কথা, এ সব স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি সূর্যের আলো ও উত্তাপ থেকে আড়াল করা জরুরী। নতুবা যন্ত্র, আয়না ও লেন্স ঝলসে যাবে। তাই এক্ষেত্রে প্রায় ২২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪ মিটার ব্যাসের সানশিল্ড লাগানো হয়েছে। এদিকে জেমস ওয়েবের মূল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্যে স্পেসক্রাফটের কাজ প্রণিধানযোগ্য। আর মজার ব্যাপার হলো যে এর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য সোলার পাওয়ার বা সৌর কোষ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন যে, বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টাপূর্বক বহু সময় ব্যাপী এত অর্থ ব্যয় করে নানা রকম স্পর্শকাতর, মূল্যবান ও জটিল যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে এই জেমসওয়েব তৈরী করেছেন কেন এবং কি কি এর বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য? এর জবাবে উল্লেখ্য যে, প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ততার স্বার্থে এর উদ্দেশ্যে পুরোপুরি ব্যাখা না করে স্বল্প কথায় কিছুটা তুলে ধরা হলো। প্রথমতঃ শৈশবের ঊষালগ্নের মহাবিশে^র স্বরূপ উদঘাটন এবং মহাবিস্ফোরণের (ইরম নধহম) পর থেকে আদি সময়ের গ্যালাক্সিগুলোর আলোর সন্ধান করতে পারলে বোঝা যাবে কিভাবে এই গ্যালিক্সগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্তন অনুসন্ধান। এ ব্যাপারে প্রথম যুগের থেকে বর্তমান যুগের গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে কী কী বিবর্তন এবং কিভাবে হয়েছে, তা জানা। তৃতীয়তঃ নক্ষত্রগুলো কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রহ-উপগ্রহ সহ নক্ষত্র জগতের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। চতুর্থতঃ আমাদের সৌরজগতসহ অন্য গ্রহ উপগ্রহগুলোর বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম পরীক্ষা করে দেখা এবং একই সঙ্গে অন্য গ্রহ বা উপগ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। এই উদ্দেশ্যেসমূহ সামনে রেখে গত বছরের (২০২১) শেষের দিক হতে এই জেমস ওয়েব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে জেমস ওয়েব উৎক্ষেপণের দুইশত দিনের মাথায় অর্থাৎ ১২ জুলাই এই টেলিস্কোপ কর্তৃক প্রেরিত ৫টি ছবি উন্মুক্ত করা (স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কর্তৃক বাছাইকৃত) হয়েছে, তাতে জ্যোর্তিবিজ্ঞান জগতে নতুন দ্বার উম্মোচিত হয় এবং এতে মহাবিশে^র সৃষ্টির রহস্যের জট খোলা ও নতুনত্বের আমেজে সারা অবনিতে ঢেউ খেলে যায়। এই পাঁচটি ছবির প্রথমটি হলো মহাজগত সৃষ্টির গোড়ার সেই গ্যালক্সি, যা ১৩০০ বছর আগের ছবি। এই ছবির মাধ্যমে যে উত্তর মিলবে, তা হলো মহাবিস্ফোরণের (ইরম ইধহম) পর প্রথম সবকিছু অন্ধকার ছিল এবং সময় (ঞরসব) পর্যন্ত ছিল না। আর পদার্থ যদি কিছু থেকে থাকে, তা ছিল কেবল ডার্ক ম্যাটার (উধৎশ গধঃঃবৎ)।

তৎপর দ্বিতীয় ছবি থেকে জানা যায় যে, পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি গ্রুপ, যার কেন্দ্রে আছে সুপারম্যাসিভ বা প্রচন্ড ভরসম্পন্ন ব্লাকহোল এবং সেখান থেকে একটি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। তৃতীয় ছবিতে যা দেখা যায়, তাহলো কারিনা নেবুলারের ছবি। এটি মূলত নক্ষত্রের জন্ম ভূমি। তাছাড়া চতুর্থ ছবিতে উঠে এসেছে, সাউদার্ন রিং নেবুলা, সেখানে আছে গ্যাসের মেঘ, যা সম্প্রসারিত চারিদিকে। আর পঞ্চম ছবিটি হলো সৌরজগতের বাইরে গ্রহ (এস্কাপ্লানেট) এটি পৃথিবীর থেকে প্রায় ১১৫০ আলোকবর্ষ দূরে বিদ্যমান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *