আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর

আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর মানবদেহ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ

আল্হামদুলিল্লাহ। আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর! সকল প্রশংসা সেই মহান রবের- যিনি আমাদেরকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ও আকৃতিতে সকল সৃষ্ট জীবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ সৃষ্টিরাজি নিয়ে যতই চিন্তা করি ততই শ্রদ্ধা আর আনুগত্যে শির নত হয়ে আসে সেই মহান স্রষ্টার সামনে। রহস্যে ঘেরা আর কুদরাতে ভরা এ সৃষ্টি কুলের মধ্যে মানব দেহের সৃষ্টি যেন আরো বিস্ময়কর আরো অভিনব।

মহাবিশ্বের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি মানুষ। সৃষ্টি জগতের অগণিত সৃষ্টির মধ্যে নিতান্তই  ক্ষুদ্র এ সৃষ্টি মানুষকে আল্লাহ মর্যাদা দিয়েছেন সৃষ্টির সেরা জীব রূপে। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘য়ালা মানুষকে এমন বিবেক-বুদ্ধি মেধা-মনন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন- যা দিয়ে মানুষ সৃষ্টি জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সৃষ্টি থেকে শুরু করে বিশালকায় সৃষ্টির উপর কর্তৃত্ব চালিয়ে আসছে। ক্ষুদ্র মানুষের এমন বিস্ময়কর যোগ্যতা আর প্রতীভাই প্রমাণ করে মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান কারিগর। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, শিরা-উপশিরায়, কোষ-পেশীতে অসম্ভব ক্ষমতা দিয়েছেন মহান ক্ষমতাধর আল্লাহ। যে সুনিপুণ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ মানুষকে এমন সুষম ও সুন্দর অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি মানুষ কতটুকু শ্রদ্ধাবনত ও কৃতজ্ঞ?

মহান আল্লাহ বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেছেনঃ

“হে মানব মন্ডলি! কোন্ জিনিসটি তোমাকে তোমার মহিমাম্বিত রবের ব্যাপারে ধোঁকায় নিমজ্জিত করেছে? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করেছেন এবং যেভাবে চেয়েছেন তোমাকে আকৃতি দিয়েছেন” (সুরা ইনফিতার: ৬-৮)।

মানব দেহের গঠন যে সকল সৃষ্টির মধ্যে সুন্দরতম সে কথার সত্যতা খুজে পাই আমরা মহান রবের এ ঘোষণায়ঃ

“অবশ্যই আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি নীচ থেকে নীচ স্তরে (তার কর্মের কারণে) (সুরা ত্বীন:৫-৬)।

ন্যায় বিচারের দাবী হলোঃ জ্ঞান-বুদ্ধি, রূপ-গুণ এবং যোগ্যতা যার বেশী সঙ্গত কারণেই স্রষ্টার প্রতি তার বিনয়ী হওয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং আনুগত্যের মস্তককে অবনত করে দেয়া অধিকতর জরুরী।

মানব দেহের সুন্দর এ অবয়বকে সুন্দরতম কাজে ব্যবহারই স্রস্টার অভিপ্রায়। যিনি মানব দেহের এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে  যত সুন্দরভাবে স্রস্টার অভিপ্রায় অনুযায়ী ব্যবহার করবেন- তিনি তত বেশী প্রিয় পাত্র হবেন মহান স্রস্টার কাছে। পক্ষান্তরে মানব দেহের এ সুন্দর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের  অপব্যবহারই তার স্রষ্টার নারাজীর কারণ হবে এবং স্রস্টার রোষানলে পুড়ে অপমানিত হবে; কেননা ব্যক্তি হচ্ছে ঐ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরই সমষ্টি। কাজেই ব্যক্তির কোন অঙ্গ জাহান্নামী হওয়ার মানেই হলো ব্যক্তির জাহান্নামী হওয়া। আবার ব্যক্তির কোন অঙ্গের জান্নাতী হওয়ার মানেই হলো ব্যক্তি জান্নাতী হওয়া।

উল্লেখ্য যে, ইসলাম মানব দেহের নৈতিক হেফাজত ও শারীরিক সুস্থতার দিকেও গুরুত্বারোপ করেছে। যেমনঃ মহানবী সা.বলেছেন”

“জেনে রেখো! নিশ্চয়ই মানব দেহে এমন একটি গোশতের টুকরা রয়েছে; যা সুস্থ হলে গোটা মানব দেহ সুস্থ হয়ে যায়। আবার তা অসুস্থ হলে গোটা দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। জেনে রেখো! তা হলো ক্কালব বা আত্মা বা হৃৎপিন্ড ।” (বুখারী: হাদীস নং-৫২, মুসলিম: হাদীস নং-১৫৯৯)

আর এ কথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, অন্তরের সুস্থতার উপর একজন মানুষের ঈমানের সুস্থতা নির্ভর করে। সেই সাথে কারো হার্ট বা অন্তর যদি সারা দেহে সুষম ভাবে সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ করার কাজটি সঠিক ভাবে সম্পাদন করতে পারে তবে তার দেহকে সুস্থ বলা যেতে পারে।

মানব দেহ  হলো একটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ দেহ কাঠামো যা মাথা , ঘাড়, বক্ষ, পেট, বাহু, হাত, পা এবং পায়ের পাতা সম্বলিত। মানব দেহের প্রতিটি অংশই বিভিন্ন ধরনের কোষ দ্বারা গঠিত, যা জীবনের মৌলিক একক। মানবদেহ প্রধানত অস্থি বা হাড় ও উপাস্থি বা কার্টিলেজ নামক কাঠামোর উপরে গঠিত। এই অস্থিগুলি পরস্পর সংলগ্ন থাকে ও সন্ধি তৈরী হয় কতক গুলি তন্ত্রের সাহায্যে। এই অস্থি গুলির উপর থাকে মাংস তার উপর থাকে চর্বি এবং সবার উপরে থাকে ত্বক। দেহের এই সব অংশকে সতেজ রাখার জন্য প্রয়োজন রক্ত চলাচলের। হৃৎপিন্ড থেকে ধমনী  এর মধ্যে দিয়ে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। আবার শিরা  দিয়ে তা হৃৎপিন্ডে ফিরে আসে।

 মস্তিষ্ক মাথার খুলির মধ্যে থাকে। তার সাথে যুক্ত থাকে সুষুষ্মাকান্ড। তার থেকে বের হয় অজস্র স্নায়ুমন্ডল। এই সব স্নায়ু সারা দেহে ছড়িয়ে থাকে। দেহের যে কোন স্থানের সব অনুভূতি এই সব স্নায়ু  দিয়ে সঞ্চালিত হয় মস্তিষ্কে। কোনও অনুভূতি দেহের কোনও স্থানে জাগলে, তা যায় মস্তিষ্কে । আবার মস্তিষ্ক  থেকে যে কোনও আদেশ এই সব স্নায়ু দিয়েই বাহিত হয় বিভিন্ন পেশিতে।

 গোটা মানব দেহ যেন একটা কারখানা। আর মানুষের মধ্যে যে চিন্তা, ভাবনা প্রভৃতি ক্ষমতা আছে, তার কেন্দ্র হলো মস্তিষ্ক আর এটি হলো মানব দেহের মানবিকতার মূল উৎস। আবার জীবনের জন্য প্রধান উৎস হলো রক্ত পরিবহনের কেন্দ্র হৃৎপিন্ড। এই হৃৎপিন্ডের কর্মক্ষমতার অভাব হলে মানুষ মারা যায়।

 চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানবদেহে দু ধরনের অঙ্গ আছে।

(১) বাহ্যিক অঙ্গঃ যেমনঃ মাথা, চোখ, কান, মুখ, হাত,পা ইত্যাদি।

(২) অভ্যন্তরীন অঙ্গ। যেমনঃ পাকস্থলি, ডিওডেনাম, ইলিয়াম, মলাশয়, হৃৎপি, যকৃত, অগ্নাশয়, প্লীহা, ফুসফুস, বৃক্ক, শুক্রাশয়, ডিম্বাশয় ইত্যাদি।

এছাড়াও মানব দেহে রয়েছে পরিপাক, শাসন, রেচন, প্রজনন ইত্যাদি শরীর বৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য কতিপয় তন্ত্র।

মানব দেহের নিউরো ক্যামিকেল বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানী গণ বিচিত্র সব তথ্যাদির সমাবেশ ঘটিয়েছেন। আমি এখানে একাধিক গ্রন্থ থেকে সামান্য কিছু তথ্য তুলে ধরছি:

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ পৃথিবীতে যত ধরনের পদার্থ আছে তার অনুরুপ কিছু পদার্থ মানব দেহে আল্লাহ পাক সন্বিবেশিত করেছেন।সুবহান আল্লাহ! পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ায় মানুষ যাতে সাচ্ছন্দে- নিরাপদে পদচারনা করতে পারে- সে প্রয়োজন থেকেই হয়তো এ ব্যবস্থাপনা। আল্লাহ পাকই সমধিক অবগত।

মানব দেহের নিউরোক্যামিকেল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের দেহে যে পরিমান চর্বি আছে তা দিয়ে আস্ত একটি কাপড় কাঁচা সাবান এবং প্রায় ৭৬ টি মোমবাতি তৈরী করা যাবে। যে পরিমান ফসফরাস আছে তা দিয়ে ৮০০ দিয়াশলাই, যে পরিমান লোহা আছে তা দিয়ে বড় ধরণের ৪ টি পেরেক তৈরী করা যাবে। যে বিদ্যুত আছে তা দিয়ে ২৫ পাওয়ারের একটি বাল্বকে অন্তত : ২৫ মিনিট জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব। মানব দেহে যে পরিমান তাপ উৎপন্ন হয় তা দিয়ে ঘন্টায় ১ লিটার করে পানি গরম করা যায়। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরে যে পরিমান কার্বন থাকে তা দিয়ে ৯০০০টি পেন্সিল তৈরী করা যায়। একজন মানুষের শরীরে গন্ধক আছে ১০ তোলা, লবণ আছে ৬ চামচ, রক্ত আছে ৪/৫ গ্যালন। মানুষের শরীরে যে ধমনী, শিরা এবং কৈশিক নালী আছে তা জোড়া দিলে ৬০ হাজার মাইল লম্বা হবে। মানুষের সম্পূর্ণ পরিপাক তন্ত্রকে লম্বা করে জোড়া দিলে এর দৈর্ঘ্য তিন তলা ভবনের সমান হবে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ/সেল আছে যা প্রকৃতির দিক প্রায় ২০০ প্রকার।

এ গুলো এতটাই ক্ষুদ্র যে, একটি পিনের মাথায় ১০ লক্ষ কোষ বসতে পারে। আমাদের মস্তিস্কে ১০০ বিলিয়ন ব্রেন কোষ প্রতি সেকেন্ডের হাজার ভাগের এক ভাগ গতিতে কাজ করতে পারে; এবং সেকেন্ডে ৯ কি: মি: গতিতে বার্তা পাঠাতে পারে। সুবহানাল্লাহ!

আসুন, আমরা মহান স্রস্টার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হই এবং আনুগত্যের হাতকে তাঁর দিকে প্রসারিত করি।

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়ব আলী, কামিল, (হাদীস); এম,এ (ইসলামিক স্টাডিজ)
অবসরপ্রাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *